বাংলাদেশের পরিচয়

বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

অথবা, ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

ভূমিকা : পৃথিবীর মানচিত্রে ছােট একটি স্থান দখল করে আছে তার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে । ভৌগােলিক অবস্থান আর ভূ-প্রকৃতিতে রয়েছে এক নিজস্ব স্বকীয় সত্তা। এ সুন্দর সবুজ শ্যামলা বাংলাদেশের ভৌগােলিক অবস্থার পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণ করে তার বুকে বয়ে যাওয়া অজস্র নদী।প্রাচীনকালে বিশাল এলাকার সমষ্টিকে বাংলা নামে অভিহিত করা হতাে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে কালের পরিক্রমায়, নদীর পথ পরিবর্তনে এটি একটি নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করেছে। আর এই জনপদটির ভূ-প্রকৃতিও অনেক বৈচিত্র্যময়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি অসংখ্য নদ-নদী এ দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। যা এ দেশকে করেছে সৌন্দর্যের এক অপরূপ লিলা ভূমি । নিচে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আলােচনা করার প্রয়াস চালানাে হলাে।

বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের ভৌগােলিক অবস্থান 

 

বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত।২০°৩৪’ উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৬°৩৮° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১ থেকে ৯২°৪২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিস্তৃতি। বাংলাদেশের মধ্যভাগ। দিয়ে অতিক্রম করেছে কর্কটক্রান্তি রেখা বাংলাদেশ তিন দিকে স্থল এবং একদিকে জল দ্বারা বেষ্টিত। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, মেঘালয় ও আসাম। পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা রাজ্য ও মিজোরাম এবং মিয়ানমার, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ।



আরো পড়তে পারেন:বাঙালি জাতির নৃ-গােষ্ঠীর পরিচয় সম্পর্কে মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে লিখ।
বাংলাদেশের আয়তন:  বাংলাদেশের মােট আয়তনের মধ্যে নদ-নদী অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৯৩৮০ বর্গ কিলােমিটার। বনাঞ্চলের আয়তন ২২,৫৮৪ বর্গ কিলােমিটার। বাংলাদেশের মােট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলােমিটার। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ১২ নটিক্যাল মাইল এবং অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল ।
বাংলাদেশের সীমারেখা : বাংলাদেশের সর্বমােট সীমারেখা ৫১৩৮ কি.মি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভারত সীমারেখার দৈর্ঘ্য ৪১৪৪ কিলােমিটার। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমারেখা দৈর্ঘ্য ২৮৩ কিলােমিটার এবং বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৭১১ কিলােমিটার।
প্রান্তীয় অবস্থান ও সমুদ্র হতে দূরত্ব এবং সমুদ্রের অবস্থান অনুসারে বিভিন্ন দেশের অবস্থান মহাদেশীয় প্রান্তীয়, উপদ্বীপীয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অবস্থান প্রান্তীয় । এরূপ অবস্থানের জন্য এর দক্ষিণে ভগ্ন উপকূলে সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠেছে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সুলভ জলপথে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে গড়ে ওঠেছে।
ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বের যতগুলাে ব-দ্বীপ রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলাে বাংলাদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ পৃথিবীর একক বৃহত্তম ব-দ্বীপ। পদ্মা, মেঘনা, ও যমুনা নদী পশ্চিম-উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে একযােগে এ সুবিশাল ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। সীমিত উচ্চভূমি ছাড়া সমগ্র দেশ বিস্তীর্ণ সমভূমি এদেশের ভূ-খণ্ড উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু। ফলে প্রবাহিত সব নদ-নদী এবং উপনদী-শাখা নদীগুলাে উত্তরদিক হতে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে।
ভূমির পার্থক্য ও গঠনের দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় ।
১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ;
২. প্লাইস্টোসিনকালের সােপানসমূহ বা চত্বরভূমি;
৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি।
নিম্নে এগুলাের আলােচনা করা হলাে-
১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ : রাঙ্গামাটি, বান্দারবন, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এলাকাগুলাে নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। আনুমানিক টারশিরারি যুগে হিমালয় পর্বত উঠিত হওয়ার সময় মায়ানমারের দিক থেকে আগত গিরিজনি আলােড়নের ধাক্কায় ভাজগ্রস্ত হয়ে এসব পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এদের টারশিয়ারি পাহাড় বলা হয় ।

আরো পড়তে পারেন:বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির নৃ-তাত্ত্বিক পটভূমি আলােচনা কর।
এ পাহাড়গুলাের বৈশিষ্ট্য হলো বেলে পাথর, স্ট্রেট জাতীয় প্রস্তর এবং কর্দমের সংমিশ্রণে গঠিত। পাহাড়গুলাের গায়ে ক্ষুদ্র বৃহৎ বৃক্ষরাজির বন এবং অসংখ্য ঝােপ জঙ্গল রয়েছে। তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, টারশিয়ারি যুগের হিমালয় পর্বত গঠনের সময় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল বলে এগুলােকে টারশিয়ারি পাহাড় বলে ।
এ পাহাড়ি অঞ্চলকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ,
(খ) দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ।



(ক) উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ : ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনাে জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তর পূর্বাংশ এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের দক্ষিণাংশের ছােট বড় বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলাে এ অঞ্চলের অন্তর্গত। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের দক্ষিণে পাহাড়গুলাের উচ্চতা ২৪৪ মিটারের বেশি না। শেরপুর ও ময়মনসিংহের উত্তর সীমানায়ে কিছু কিছু পাহাড় আছে। উত্তরের পাহাড়গুলাের মধ্যে চিকনাগুল খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া উল্লেখযােগ্য। সিলেট জেলার পাহাড়ি অঞ্চল সিলেট শহরের উত্তরপূর্ব দিকে ১৮৬ বর্গকিলােমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এ পার্বত্য ভূমির উচ্চতা ৬০
থেকে ১০০ মিটারের বেশি নয়।সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক শহরের, উত্তরে প্রায় ৪০ বর্গকিলােমিটার স্থান নিয়ে একটি টিলা পাহাড় অবস্থিত। এটি ছাতক পাহাড় নামে পরিচিত। এ পার্বত্য ভূমির গড় উচ্চতা ৪০-৬০ মিটার মৌলভাবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সীমানায় অবস্থিত পাহাড়গুলাে কোনােরূপ গিরি শ্রেণি গঠন করেনি।
এসব পাহাড়ের ডালগুলাে খাড়া এবং উপরিভাগ অসমান। এদেরকে ত্রিপুরার পাহাড় বলা হয়। শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার উঞ্চর সীমানায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারাে পাহাড়ের সামান্য বিচ্ছিন্ন অংশ দেখা যায়। এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তাই এখানকার পাহাড়ের ঢালে প্রচুর চা উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ চা বাগান এ অঞ্চলেই অবস্থিত। এ অঞ্চলে আনারসও উৎপন্ন হয়। এছাড়া এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ ও বেত পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, চুনাপাথর, কয়লা প্রভৃতি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
(খ) দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ : খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় এবং চট্টগ্রামের অংশ বিশেষ এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এ পাহাড়গুলাের গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়) যার উচ্চতা ১২৩১ মিটার। এটা বান্দরবানে অবস্থিত এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিউক্রাডং যার উচ্চতা ১২৩০ মিটার। এটি অবস্থিত বান্দারবানের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে। বান্দরবানের অপর দুটি উচ্চতর পাহাড় চূড়া হচ্ছে মােদরামুয়াল ১০০০ মিটার ও পিরামিড। এর উচ্চতা ৯১৫ মিটার। এসব পাহাড় বেলে পাথর, শেল ও কর্ম শিলা দ্বারা গঠিত। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলাের মধ্যবর্তী উপত্যকা কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী হালদা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়েছে।
২. প্লাইস্টোসিনকালের সােপানসমূহ বা চত্বরভূমি : প্রায় ২৫,০০০ বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিনকালের সােপানসমূহ বা চরভূমি আন্তবরফ গলা পানিতে প্লাবিত হয়ে গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ অঞ্চলের মাটির রং লাল ও ধূসর।
নিচের প্লাইস্টোসিনকালের সােপানসমূহ বা চত্বরভূমির বর্ণনা দেওয়া হলাে :
(ক) বরেন্দ্রভূমি : বরেন্দ্র প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে প্রাচীনতম অঞ্চল । এ বরেন্দ্রভূমি রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৯৩২০ বর্গকিলােমিটার এলাকা জুড়ে আছে। প্লাবন সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার। বঙ্গ অববাহিকায় এটি সর্ববৃহৎ প্লাইস্টোসিন যুগের উচ্চভূমি । এ এলাকার ভূমি অসমতল এবং মাটি লাল ও কাঁকরময়। এটি পশ্চিমে মহানন্দা ও পূর্বে করতােয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। গভীর খাতবিশিষ্ট আঁকাবাকা ছােট ছােট কয়েকটি স্রোতস্বিনী এ অঞ্চলে রয়েছে। এসব
স্রোতস্বিনী খাড়ি নামে পরিচিত। বরেন্দ্র পূর্ণ অঞ্চল পুনর্ভবা, আত্রাই ও যমুনা নদী দ্বারা চারটি অংশে বিভক্ত। এর পূর্বদিকের তিনটি অংশ বাংলাদেশের অন্তর্গত। মহানন্দা ও পুনর্ভর মধ্যবর্তী অপর অংশটি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের অন্ত-গত। বরেন্দ্র অঞ্চল কৃষিকার্যের জন্য উপযােগী। ধান এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল। এছাড়াও যেসব কৃষি পণ্য এখানে উৎপন্ন হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলাে পাট, ভুট্টা, পান ইত্যাদি।



(খ) মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় : উত্তরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত অর্থাৎ ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল ও গাজীপুর অঞ্চল জুড়ে এর বিস্তৃতি ! এর মােট আয়তন প্রায় ৪১০৩, বর্গ কিলােমিটার। মাটি কংকর মিশ্রিত ও লাল ।
প্লাবন সমভূমি থেকে এর পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের উচ্চতা ৬ মিটার কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর দিকের উচ্চতা ৩০ মিটার। মধুপুর গড়ের অঞ্চলটি পাহাড়ের ক্ষয়িত অংশ বিশেষ। মধুপুর গড়কে অনেক বিশেষজ্ঞ নদী সােপান, আবার কেউ কেউ একে উথিত ব-দ্বীপও বলেন। বরেন্দ্রভূমির মতাে এখানকার মাটির রং দেখতে লাল এবং কঙ্করময় বলে কৃষি কাজের পক্ষে, বিশেষ উপযােগী নয়। এখনও ভূ-ভাগ বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং বাংলাদেশের গাজারি বৃক্ষের কেন্দ্র। মধুপুর এলাকায়
আনারস ও নানা ধরনের সবজি উৎপন্ন হয়। পানি সেচের মাধ্যমে এ অঞ্চলে কিছু ধানের চাষ হয় ।
(গ) লালমাই পাহাড় : কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কি.মি. দক্ষিণে লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। লালমাই পাহাড়ের আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গ কিলােমিটার এবং গড় উ, ৩ ২১ মিটার। এর মাটি লালচে নুড়ি এবং বালি ও কংকর দ্বারা গঠিত । এ পাহাড়ের পাদদেশে আকু তরমুজ ইত্যাদি চাষ হয় ।
৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভুমি :বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি এক অপরূপ সাজে সজ্জিত।কোথাও উঁচু,কোথাও নিচু আবার কোথাও সমান। আর এরই ধারাবাহিকতায় টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ এবং প্লাইস্টোসিনকালের সােপান-মূহ ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ নদী বিধৌত এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। অসংখ্য ছােট বড় নদী বাংলাদেশের সব জালের মতাে ছড়িয়ে আছে।সমতল ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত বলে এ নদীগুলাে বন্যার সৃষ্টি করে।দেশের অধিকাংশ অঞ্চল তখন জলমগ্ন হয়। বছরের পর বছর এভাবে বন্যার সাথে পরিবাহিত পলিমাটি সঞ্চিত হয়ে পলল সমভূমি গঠিত হয়।এর আয়তন প্রায় ১,২৪,২৬৫ বর্গ কিলােমিটার।বাংলাদেশের উত্তরাংশ থেকে সাগর উপকূলের দিকে সমভূমির ঢাল ক্ৰমনিম্ন।সুন্দরবন অঞ্চল প্রায় সমুদ্র সমতলে অবস্থিত। কিন্তু সমুদ্র সমতল থেকে দিনাজপুরের উচ্চতা ৩৭৫০ মিটার,বগুড়ার উচ্চতা ২০ মিটার, ময়মনসিংহের উচ্চতা ১৮ মিটার এবং নারায়ণগঞ্জ ও যশােরের উচ্চতা ৮ মিটার। রংপুর দিনাজপুর উত্তরাংশ নােয়াখালী-কুমিল্লার পূর্বাংশ গড়াই মধুমতি অঞ্চলের পশ্চিমাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের উত্তরাংশ দেশের অন্যান্য সমতল ভূমি থেকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ। এসব সমভূমির বিভিন্ন স্থানে বহু নিম্নভূমি বা জলাশয় দেখতে পাওয়া যায়,এর অধিকাংশ পরিত্যক্ত অশ্বক্ষুরাকৃতি নদীখাত বা ভূপৃষ্ঠের অবনমনের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এগুলােকে বিল,বিল বা হাওড় বলে ।চলন বিল, মাদারীপুর বিল ও সিলেট অঞ্চলের হাওরসমূহ বর্ষার পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে হদের আকার ধারণ করে।সমগ্র সমভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকার স্তর খুব গভীর এবং ভূমি অতি উর্বর এবং মানুষের বসবাসের উপযােগী।তবে এ অঞ্চল সর্বত্র একই রূপ নয় বলে একে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।যেমন –

(ক) কুমিল্লা সমভূমি : চাদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিকাংশ এবং লক্ষ্মীপুর নােয়াখালী, ফেনী ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ জুড়ে এ সমভূমি অবস্থিত। কুমিল্লা সমভূমির মােট আয়তন ৭৪০৪ বর্গ কিলােমিটার এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে উচ্চতা ৩.৬ মিটার, অন্য মতে ৬ মিটার। এ সমভূমির বন্ধুরতা অনুচ্ছ এবং বর্ষাকালে প্রায় ডুবে থাকে। তবে এ অঞ্চলের ভূমি উর্বর বলে প্রচুর ধান, পাট, ও অন্যান্য ফসল জন্মে থাকে।
(খ) সিলেট অববাহিকা : সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় অধিকাংশ এবং কিশােরগঞ্জে ও নেত্রকোনা জেলায় পূর্বদিকের সামান্য অংশ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এটি সংলগ্ন প্লাবন সমভূমি হতে অপেক্ষাকৃত নিচু। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে এ অববাহিকার উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার। এ অঞ্চল বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যায় এবং শীতকালে পানি নেমে গেলে এখানে বােরাে ও ইরি ধানের চাষ হয়। সর্বনিম্ন স্থানগুলােতে প্রচণ্ড জলাশয়ের মতাে পানি জমে থাকে। এগুলাে হাওড় নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের বড় ধরনের পাঁচটি হাওর রয়েছে ।
(গ) পাদদেশীয় পলল সমভূমি : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বৃহত্তম রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ
স্থান জুড়ে এ সমভূমি বিস্তৃত। হিমালয় পর্বত থেকে আনিত পলল দ্বারাই এ অঞ্চল গঠিত। তিস্তা, আত্রাই, করতােয়া প্রভৃতি নদীবাহিত পলি জমা হয়ে এ ঢালু ভূমির সৃষ্টি হয়েছে, এ সমভূমি পাদদেশীয় পলল সমভূমি নামে পরিচিত। বর্ষাকালে এর সামান্য অংশ পানিতে প্লাবিত হয়। ধান, পাট, ইক্ষু, তামাক প্রভৃতি এ অঞ্চলে প্রচুর জন্মে।



(ঘ) গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা প্লাবন সমভূমি : এটিই বাংলাদেশের মূল প্লাবন সমভূমি।পদ্মা নদীর উত্তরে প্লাবন সমভুমির বাকি অংশই গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র মেঘনার প্লাবন সমভূমি নামে পরিচিত। এ প্লাবন সমভূমি বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলের অংশ বিশেষ নিয়ে বিস্তৃত। এ অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানই বর্ষার পানিতে প্রতি বছর ডুবে যায়। নদীর দুপাড় বরাবর অনুচ্চ নদী পাড়ের প্রাকৃতিক বাঁধ পশ্চাৎঢাল অগভীর জলাভূমি বা বিল, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ চর ইত্যাদি হচ্ছে প্লাবন সমভূমির উল্লেখযােগ্য ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।
(ঙ) ব-দ্বীপ অঞ্চলীয় সমভূমি : বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমের সমভূমিকে সাধারণরত ব-দ্বীপ বলা হয়। এ ব-দ্বীপ অঞ্চলটি বৃহত্তর, কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলের সমুদয় অংশ এবং রাজশাহী, পাবনা ও ঢাকা অঞ্চলের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এ ব-দ্বীপ অঞ্চলটি পদ্মা এবং এর শাখা নদীগুলাে দ্বারা বিধৌত। বর্তমানে পশ্চিম দিকের শাখা নদীগুলাে মৃত অবস্থায় রয়েছে এবং পূর্ব দিকের সক্রিয় নদীগুলাের মধ্যে আড়িয়াল-খা প্রধান।আঁকাবাঁকা নদীগুলাে এ অঞ্চলের অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করেছে। ব-দ্বীপের পূর্বাংশ বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। নদী বিল এবং দ্বীপগুলাে এ অঞ্চলের প্রধান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়া খুলনা থেকে ফরিদপুর ও বরিশাল পর্যন্ত বৃহৎ অথচ অগভীর একসারি গহ্বর রয়েছে।এরা ঝিল নামে পরিচিত। ব-দ্বীপ অঞ্চলীয় সমভূমিকে আবার তিনটি পৃথকভাবে ভাগ করা হয়। যেমন-
(i) সক্রিয় ব-দ্বীপ : পূর্বে মেঘনা নদীর মােহনা থেকে পশ্চিম গড়াই মধুমতি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ব-দ্বীপ সমভূমির পূর্বাংশকে সক্রিয় ব-দ্বীপ বলে। এর পূর্বাংশীয় অঞ্চল প্রতিবছর বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। ধান, পাট, ইক্ষু প্রভৃতি ফসল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়।এ অঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী,গােপালগঞ্জ,মাদারীপুরের বিল বা হাওরগুলােতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং শীতকালে বােরাে ও ইরি ধানের চাষ হয়।
(ii) মৃত প্রায় ব-দ্বীপ : বাংলাদেশের ব-দ্বীপ সমভূমির মধ্যে গড়াই মধুমতি নদীর পশ্চিমাংশকে মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ বলা হয়। এটা বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশাের অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানব্যাপী বিস্তৃত। এ অঞ্চলের অধিকাংশ নদী ভরাট হয়ে মৃত প্রায় অবস্থান রয়েছে। গুচ্ছ ঋতুতে নদীগুলাে প্রায় শুকিয়ে যায়।
(iii) তেজ্য সমভূমি : বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলীয় সমভূমির দক্ষিণ ভাগের যে অংশে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার ভাটার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সে অংশকে যােজ্য সমভূমি বলে। এ অঞ্চলে ছােট ছােট বহু নদীনালা আছে। এরা অসংখ্য শাখা প্রশাখায় ও খড়িতে বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এ সমভূমি অঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের বনভূমি রয়েছে।এ বনভূমি সুন্দরবন নামে সুপ্রসিদ্ধ এ অঞ্চলের নদীতে প্লাবন খুব কম.



(iv) চট্টগ্রামের উপকূলীয় সমভূমি: এ সমভূমি, ফেনী নদী হতে কক্সবাজারের কিছু দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি গড়ে প্রায় ৯.৬ কিলােমিটার প্রশস্ত । কিন্তু কর্ণফুলী নদীর মােহনায় এর দৈর্ঘ্য ২৫.৬ কিলােমিটার। এ সমভূমির কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামহুরী, বাশখালি প্ৰভৃত নদীবাহিত পলল দ্বারা গঠিত। এছাড়া সমুদ্র বটে বালু, সৈকত, বালিয়াড়ী, কর্দম ভূমি ইত্যাদি উপকূলীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এখানে পরিলক্ষিত হয়। এর কোনাে কোনাে স্থানে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরি হয়।
এ অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজ ফসলও হয় ।

উপসংহার : বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য বিরাজ করে। আর এদেশের ভূ-প্রকৃতি মানুষের জীবনধারা ও সামগ্রীক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আর এ দেশের ভৌগােলিক অবস্থান সামগ্রীকভাবে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কেননা বাংলাদেশের তিন দিকে ছিল এবং এক দিকে জলক আর এদিকে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সামুদ্রিক বন্দর যা অর্থনীতির মূল পাইপ-লাইন।আর এ অপরূপ ভূ-প্রকৃতিতে সামন্যতম ও বিপর্যয় ঘটলে সামগ্রীকভাবে এ জনপদের মানুষ ক্ষতির স্বীকার হয়।তার প্রকৃতিকে রক্ষায় আমাদের সতর্ক সৃষ্টি রাখা একান্তই আবশ্যক।

ধন্যবাদ আমাদের সাথেই থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

এডব্লকার ডিসেবল করুন

ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হলে আপনার ব্রাউজারে থাকা এডব্লকারটি ডিসেবল করুন।